শিরোনাম :

ভোগান্তি নিয়ে শুরু হচ্ছে ঈদযাত্রা

ভোগান্তি নিয়ে শুরু হচ্ছে ঈদযাত্রা
Admin

পথে হাজারো ভোগান্তির শঙ্কা মাথায় নিয়েই শুরু হচ্ছে রাজধানীবাসীর ঈদযাত্রা। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসের পর নাড়ির টানে বাড়ি ছুটতে শুরু করবে লাখ লাখ মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে করোনার কারণে গত দুই বছরের চার ঈদে অর্ধেকের বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়েনি। তাই এবার পরিবারে সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নিতে গ্রামের বাড়ি যাবেন কমপক্ষে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা অনুযায়ী এবার ঈদের ছুটি উপলক্ষে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ মিলে আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ বাড়ি ফিরতে পারবেন। কিন্তু বাকি মানুষওতো গ্রামের বাড়ি যাবে। এজন্য লাখ লাখ মানুষকে দেখা যাবে বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে আর লঞ্চের ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার মানুষ বাড়ি ফিরবে ট্রাকে বা অন্য কোনো যানবাহনে। তাই ঈদের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে মানুষের বাড়ি ফেরা নিয়ে ততই বাড়ছে শঙ্কা।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে যাওয়া মানুষের ঢলে সড়ক-মহাসড়কেও নামতে পারে মহাবিপর্যয়। ইতোমধ্যে বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও সদরঘাটে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। এবার সড়কপথে বড় ধরনের দুর্ভোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এবার বাড়ি ফিরতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের বেশিরভাগেরই গন্তব্য সড়কপথে। তবে ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ মোকাবিলায় মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে রাতে ফেরি চলাচল এবং নতুন ঘাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। পদ্মানদীতে নাব্য সংকটের কারণে ফেরিঘাটের অতিরিক্ত গাড়ির চাপ পড়তে পারে সড়কের ওপর। রেলপথে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে সীমাবদ্ধতার কারণে সড়কের ওপরই নির্ভর করবেন বেশিসংখ্যক মানুষ।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতিও আশঙ্কা করছে যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতি হতে পারে।  পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগের দুই বছরের চেয়ে এবার ঈদযাত্রায় মহাসড়কে দুর্ভোগ সহ্য করতে হবে বেশি। কারন অধিকাংশ সড়কে খানাখন্দ রয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় তীব্র যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ সিরাজগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কাঁচপুর সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু ও শিমুলিয়া ফেরিঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ভোগান্তি আরো বাড়তে পারে। যাত্রাপথে দুর্ভোগের দুশ্চিন্তায় নগরবাসীর অনেকেই পরিবার-পরিজনকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

বুয়েটের অধ্যক্ষ ও দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ড. মোহম্মদ হাদিউজ্জামান বলেন, ঈদে গড়ে দৈনিক যাতায়াত করা ৩০ লাখ যাত্রীর মধ্যে বাসে ৮ লাখ, ট্রেনে ১ লাখ, লঞ্চে দেড় লাখ, ব্যক্তিগত গাড়িতে চার লাখ ও বাইক রাইড করে চার লাখ লোক ঢাকা ছাড়বেন। বাকি ১২-১৩ লাখ লোক ঝুঁকি নিয়ে কাভার্ডভ্যান, ট্রেনের ছাদসহ বিভিন্ন উপায়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করবেন।

ঈদ যাত্রায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় ঢাকা-রংপুর-বগুড়া রোডে। এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। এখানে যে যানজটের সৃষ্টি হয় তা গিয়ে ঠেকে ২০-৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ঢাকা থেকে রংপুর-কুড়িগ্রাম পৌঁছতে কখনো-সখনো লেগে যায় ২৪ ঘণ্টার বেশি।

এফবিসিসিআই-র সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেছেন, বিভিন্ন সড়কে সংস্কার ও নির্মাণ কাজ চলায় যানবাহনের গতি ধীর হয়ে যায়, যা দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি কমাতে ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সব ধরনের সংস্কার ও নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে হবে।

সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দাউদকান্দি উপজেলার চার লেনের সংস্কার কাজ চলা ছাড়া বড় কোনো সমস্যা নেই। মূলত চার লেনের নির্মাণ কাজের কারণেই সেখানে দুই-তিন কিলোমিটার যানজট লেগে থাকে। কোনো কোনো সময় এই জট এসে ঠেকছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে। ঈদের সময় দাউদকান্দিতে বড় ধরনের যানজট লাগতে পারে। তবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বড় ধরনের যানজটের আশঙ্কা নেই। আগেও রাস্তাটিতে বড় যানজটের সৃষ্টি হয়নি।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীর পর থেকেই রাস্তা ভাঙ্গাচোরা ও খানাখন্দে ভর্তি। টঙ্গীতে থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ভোগান্তিতে দীর্ঘদিনের। এছাড়া বিআরটি-র নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যাতায়াতে মানুষজনকে অসহনীয় যানজটে পড়তে হবে।

সড়ক ও নৌপথের ওপর চাপ কমাতে রেলপথে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের জন্য বেশি ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে ৬ থেকে ৭ জোড়া বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করা হবে। বর্তমানে ২০১টি ইঞ্জিন বিভিন্ন ট্রেনের সঙ্গে চলাচল করছে। ঈদের সময় আরো ১৮টি ইঞ্জিন দিতে পারবে লোকোমোটিভ বিভাগ। সেই হিসাবে মোট ২১৮টি ইঞ্জিন প্রস্তুত থাকবে।

প্রতিবার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের বড় সমস্যা হয়ে থাকে পদ্মা পাড়ি দেওয়া। এবার এই সমস্যা আরো বাড়বে। বর্তমানে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাটে ফেরিতে বাস ও ট্রাক পারাপার হচ্ছে না। পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি ও ঘাট চাহিদার তুলনায় কম। ফলে যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে দুর্ভোগে। মূলত ঘাট সংকট, ফেরি স্বল্পতা, নদীর নাব্যতা সংকটের সমাধান না হলে এবার ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে বাড়তি গাড়ির চাপ সামাল দিতে ঈদের আগে পাঁচদিন ও পরের পাঁচদিন মোট ১০ দিন অপচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় পণ্যবাহী গাড়ির চাপ বেড়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ঈদ উপলক্ষে ২১টি ফেরি চলাচল করবে। বর্তমানে ছোট-বড় মিলে ১৯টি ফেরি থাকলেও গতকাল ১৭টি ফেরি চলাচল করছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুটি ফেরি পাটুরিয়ার ভাসমান কারখানা মধুমতিতে মেরামতে রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চৌহান বলেন, ঈদের আগে ও পরে ১০ দিন অপচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেজন্য পণ্যবাহী ট্রাকের চাপ রয়েছে। এ ছাড়া দুটি ফেরি বিকল হয়ে পড়ায় যানবাহন পারাপার ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে এ নৌপথে ছোট বড় ১৭ টি ফেরি চলাচল করছে।

জানা গেছে, সরকারি ক্যালেন্ডারে আগামী ২ থেকে ৪ মে তিনদিন ঈদের ছুটি নির্ধারিত আছে। তার আগে ১ মে শ্রমিক দিবস তথা মে দিবসের ছুটি। এর আগে ২৯ ও ৩০ এপ্রিল শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে এবার মূলত ঈদের ছুটি শুরু হবে ২৯ এপ্রিল। মাঝখানে ৫ মে বৃহস্পতিবার অফিস খোলা। এরপর ৬ ও ৭ মে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ৫ মে বন্ধ থাকলে ঈদে ৯ দিনের সরকারি ছুটি থাকত। এই দিন ছাড়াও এবার ৬ দিনের লম্বা ছুটিতে যাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর ফলে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে সড়কপথে বিভিন্ন রুটে ২৯ ও ৩০ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিটের চাপ অনেক বেশি। এই দুই দিনের অগ্রিম টিকিট এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ বিক্রি হয়ে গেছে। সায়েদাবাদের হানিফ পরিবহনের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার মূলত বেশি ছুটির কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২৯ এপ্রিল থেকে ছুটি শুরু হওয়ায় এদিন ও ৩০ এপ্রিল টিকিটের চাপটা একটু বেশি। এই দুই দিনের ৮০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। সৌদিয়া পরিবহনের কর্মকর্তা সুমন বলেন, ঈদের ছুটি বেশি থাকায় অনেকে ধীরে ধীরে যাচ্ছেন। ২৮-৩০ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বেশিরভাগই বিক্রি হয়ে গেছে। ১-২ মে’র টিকিট এখনো রয়ে গেছে।

ঈদ যাত্রা নিবিঘ্ন করতে বিক্রি হচ্ছে রেলের অগ্রিম টিকেট। ২৩ এপ্রিল দেওয়া হয় ২৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট। ২৪ এপ্রিল দেওয়া হয়েছে ২৮ এপ্রিলের টিকিট। ২৫ এপ্রিল দেওয়া হয় ২৯ এপ্রিলের টিকিট। ২৬ এপ্রিল দেওয়া হবে ৩০ এপ্রিলের টিকিট। ২৭ এপ্রিল ওেয়া হবে ১ মের অগ্রিম টিকিট। তবে ট্রেনের টিকিট যেন সোনার হরিণ! অগ্রিমের টিকিটের চাপে পড়েছে কমলাপুর রেলস্টেশনসহ পুরো স্টেশনপাড়া। ৩০ এপ্রিলের টিকিট গতকাল দেওয়া শুরু হলেও স্টেশনে টিকিটপ্রত্যাশীদের চাপ ছিল এর আগের দিন থেকেই। যদিও লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই অধিকাংশের। কারণ মোট টিকিটের সংখ্যার চেয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিল ১০ গুণ বেশি মানুষ। একেক লাইনে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ। এদের অধিকাংশই ২৯ এপ্রিলের টিকিট না পেয়ে রেলস্টেশনে থেকে গেছেন ৩০ এপ্রিলের টিকিট পাওয়ার আশায়। কেউ এক দিন আবার কেউ দুই দিন লাইনে থাকার পর পেয়েছেন টিকিট। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত টিকিটটি হাতে পেয়ে কষ্টমাখা মুখে হাসি ফুটেছে অনেকের।

কাউন্টার ছাড়াও অনলাইনে টিকিট বিক্রি হচ্ছে ট্রেনের। তবে বরাবরের মতোই যাত্রীদের অভিযোগ টিকিট মিলছে না সেখানে। অনলাইনে টিকিট না পাওয়ার বিষয়ে স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, প্রতিটি ট্রেনের ৩৫০ সিট অনলাইনে বরাদ্দ রয়েছে। সহজ থেকে জানানো হয়েছে, এই আসনের বিপরীতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার বা কখনো কখনো এক লাখ টিকিটপ্রত্যাশী সার্ভারে হিট করছেন। যার কারণে যারা পাচ্ছেন না, তারা বলছেন যে, অনলাইনে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না।