আবার এসেছে রমজান মাস; একই সঙ্গে স্বস্তি ও অস্বস্তি নিয়ে। স্বস্তি এই যে- শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্বই গত দুই বছর রমজান মাস পার করেছে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে। একদিকে যেমন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয় ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, অন্যদিকে লকডাউনসহ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষাজনিত কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে বিরাজ করছিল অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। স্বস্তির বিষয়, এবার করোনা পরিস্থিতি বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে। শনিবারও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে নিয়মিত তথ্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, টানা তিন দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হারও রয়েছে ১ শতাংশের নিচে। অস্বস্তির বিষয়, বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। শনিবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে- ঢাকায় সবজির দরে হঠাৎ 'আগুন'। শুধু সবজিই অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে, এমন নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যে আমরা একই চিত্র দেখছি উদ্বেগের সঙ্গে। সংগত-অসংগত নানা কারণেই রমজান মাসে পণ্যমূল্যের পাশাপাশি বাড়ে আর্থিক অপরাধ ও সামাজিক অস্থিরতা। রমজান মাসে বাজারের বাড়তি চাহিদা কিংবা ঈদের 'বকশিশ' ঘিরে চাঁদাবাজি বাড়ে। রোজা ও ঈদের বাজারে নানা প্রতারণার ঘটনাও আমাদের দেশে নতুন নয়। আমরা চাই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদিকে নজর রাখবে।
আমরা জানি, প্রত্যি বছরেই রমজান মাসে বাজার ও ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। এবার সে ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে রমজান মাসজুড়ে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রির যে উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, আমরা সেটাকে প্রাথমিকভাবে সাধুবাদ জানাই। এখন বৃক্ষের পরিচয় ফলের মাধ্যমে পেতে চাইব। একই সঙ্গে টিসিবির পক্ষ থেকে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রির যে উদ্যোগ চলমান, তা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণের আনতে হবে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিও। এরই মধ্যে 'ট্রাকসেল' ঘিরে যে অনিয়ম ও অসন্তোষের চিত্র সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে রমজান মাসে বাড়তি নজরদারির বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি বাজারসংশ্নিষ্ট অন্যান্য অংশীজনকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাজার নজরদারির জন্য যে কমিটি গঠন করেছে, তাকে স্বাগত। আমরা প্রত্যাশা করি, অন্যান্য সংগঠনও এভাবে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজান মাসে বাজার পরিস্থিতি সহনীয় রাখতে বেসরকারি নানা উদ্যোগ দেখা যায়। বাংলাদেশেও কি সেই নজির অনুসরণ করা যেতে পারে না?
এ বছরও বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। ইউক্রেন সংকটের জের ধরে বিশ্বব্যাপীই খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। রমজান মাস উপলক্ষে সৌদি আরব ও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অবশ্য বিরতি এসেছে। আমরা প্রত্যাশা করি, ইয়েমেন, ইউক্রেন ছাড়াও ফিলিস্তিন কিংবা রাখাইনের মতো যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করা দেশ ও অঞ্চলগুলোতে রমজান মাস শান্তি ও স্থিতিশীলতার বাতাবরণ তৈরি করবে। আমরা আরও প্রত্যাশা করব, শাবান মাসের শেষ গোধূলিবেলায় পশ্চিম দিগন্তে উদিত কৃষকের কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ যে ত্যাগ ও সংযমের বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছে, তা সবাই শুনতে পাবে। রোজাদাররা পান, আহার ও জৈবিক চাহিদা বর্জনের পাশাপাশি আত্মিক পরিশুদ্ধির সাধনাও চালিয়ে যাবেন। আমরা জানি, রোজা অনুভব করায় ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের কষ্ট। শিক্ষা দেয় ত্যাগ ও মিতব্যয়িতার; ভোগ না করে বিলিয়ে দেওয়ার আদর্শ। দুঃখজনক হলেও সত্য, রমজানের ত্যাগ ও সংযমের এই শিক্ষা অনেকের জীবনে প্রতিভাত হয় না।
বাংলাদেশে এবার রমজান মাস যদিও শুরু হচ্ছে বসন্তকালে, মাসটি যে 'কাঠফাটা' চৈত্র- ভুলে যাওয়া চলবে না। স্বস্তির বিষয়, এই সময় দেশীয় ফল বাজারে আসতে থাকবে। বাজার যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর দেশীয় ফলে রোজাদারদের ইফতারি ও সেহরি উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে। সবাইকে সংযমের বার্তা মনে রেখে যাদের ঘরে কর্ম ও খাদ্যসংস্থান কম, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এই প্রত্যাশা রেখেই সমকাল পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাগত মাহে রমজান।