গত বৃহস্পতিবার পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবমুখরতার মধ্য দিয়ে বঙ্গাব্দ ১৪২৯-কে বরণ করে নিয়েছে জাতি। গত দুই বছর মহামারী পরিস্থিতির কারণে দেশে পহেলা বৈশাখের উদযাপন অনেকটাই রঙ হারিয়েছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় ফিরে এসেছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস। সব মিলে রাজধানীসহ সারা দেশে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল বিগত বছরের জীর্ণতা ভুলে নতুনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে সমৃদ্ধ, উন্নত, অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক বাংলাদেশের প্রত্যয় এসেছে বর্ষবরণের ঐতিহ্য হয়ে ওঠা বৈশাখী এসব আয়োজনে। পহেলা বৈশাখে ছিল সরকারি ছুটির দিন। এদিন সব সরকারি-বেসরকারি টিভি, বাংলাদেশ বেতার, এফএম ও কমিউনিটি রেডিও বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও ছিল বিশেষ বৈশাখী আয়োজন।
বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনে এবার জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়। পহেলা বৈশাখের ভোরে রমনা বটমূলে অনুষ্ঠিত হয় ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতী আয়োজন। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রাও। এবার প্রখ্যাত বাঙালি গীতিকার ও সুরকার রজনীকান্ত সেনের একটি গীতিকবিতার চরণ ধার করে শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছিল- নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। রাজধানী ছাড়াও দেশের নানা অঞ্চলে নববর্ষ উপলক্ষে বসেছে বৈশাখী মেলা এবং বিভিন্ন লোকজ অনুষ্ঠানের আসর।
রাজধানীতে রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন শুরু হয়েছিল ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে রামকেলি রাগ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। এরপর একে একে নানা ধরনের সংগীত পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীরা। রমনা বটমূলে এই আয়োজন শেষ হতেই সকাল ৯টা ১ মিনিটে ঢাবির টিএসসির সড়ক দ্বীপের সামনে থেকে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদের নেতৃত্বে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখী সাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রার সামনে-পেছনে বাদ্যের তালে তালে চলে নৃত্য, হাতে হাতে ছিল বাহারি মুখোশ। পুষ্পাকৃতির চরকি, টেপা পুতুল আর পাখির শিল্পকাঠামো শোভাযাত্রাকে দিয়েছিল বাঙালির চিরায়ত আবহ। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের ভিসি চত্বর ঘুরে আবার একই জায়গায় এসে শেষ হয়। পরে শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত শিল্পবস্তু নিয়ে চারুকলা অনুষদে ঢাকের তালে উচ্ছ্বাসে মাতেন শিক্ষার্থীরা। ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
শোভাযাত্রা শুরুর আগে উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান বলেন, একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমাদের যে দৃঢ় প্রত্যয়, সেটি আমরা ব্যক্ত করছি। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক সুদৃঢ় হোক। যে কোনো ধরনের অপশক্তি বা অশুভ শক্তি দূরীভূত হোক, সেটাও ১৪২৯ বঙ্গাব্দে আমাদের প্রত্যাশা। একইসঙ্গে আমাদের যে জাতীয় উন্নয়ন তার কার্যক্রম আরও গতি পাক।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত দুই বছর আমরা এ উৎসবটি করতে পারিনি। এ উৎসবে আমাদের প্রত্যাশা, দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান যে শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি, তা দূরীভূত হোক। আমরা মনে করি আমাদের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিশ্চয়ই বিজয়ী হব।
এদিকে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও পহেলা বৈশাখে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছিল নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। ‘নতুন দিনের সৃজন আলোয়’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ ক্যাম্পাসের নাটম-ল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ উৎসব। এদিন সকাল ১০টার দিকে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে খেলাঘর ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোল’ শিরোনামে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যের পাশাপাশি এই আয়োজনে একটি আলোচনা পর্বও ছিল। খেলাঘর কেন্দ্রীয় সংসদের চেয়ারম্যান পান্না কায়সারের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ও ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ, খেলাঘর ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান প্রমুখ।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে এদিন শুরু হয় দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন তাদের নিজেদের প্রাঙ্গণে নববর্ষ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নানা আয়োজনের খবর পাওয়া গেছে।