চলমান বন্যায় এরই মধ্যে সিলেটের ২২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশের দুই জেলা সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ২৮ হাজার হেক্টর জমির ধান। এছাড়া উত্তরঙ্গের কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলায় এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ফসলি জমির বেশিরভাগই এখন পানির নিচে। তবে এখনো প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। ফলে বন্যায় ফসলের ক্ষতি যে আরও বাড়বে তা অনেকটাই অনুমেয়। এছাড়া বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে আউশ ও আমন চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সার্বিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ফসলি জমি ছাড়াও মাছ ও গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটাও বেশ বড়। রোববার (১৯ জুন) পর্যন্ত বন্যায় দেশের পাঁচ বিভাগের ১৫টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় ৬৭ হাজার ৬১০টি মৎস্য খামার পানিতে ডুবে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এতে অন্তত ১৬ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। ফলে মাছচাষিদের ক্ষতি হয়েছে ১৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তবে সোম ও মঙ্গলবারের তথ্য হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এখন পর্যন্ত সব তথ্য পাওয়া না গেলেও এবারের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ১৯৯৮ সালের বন্যার ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সে কারণে এই বন্যায় বড় প্রভাব পড়তে পারে দেশের সার্বিক খাদ্য উৎপাদনে। অন্যদিকে এ বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের ১২টি জেলার ৭৪টি উপজেলার ৩১৬টি ইউনিয়নে ১৫ হাজার ৬০টি গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারিদের সম্ভাব্য ক্ষতি ২৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এ বন্যা অন্যান্য খাতের মতো কৃষিখাতের বড় শঙ্কার কারণ। এখন পর্যন্ত সব তথ্য পাওয়া না গেলেও এবারের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ১৯৯৮ সালের বন্যার ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সে কারণে এই বন্যায় বড় প্রভাব পড়তে পারে দেশের সার্বিক খাদ্য উৎপাদনে।
তবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বড় প্রভাব পড়ার বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। যেহেতু এসময়ে কোনো বড় ফসল মাঠে নেই, ফলে বন্যায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, খাদ্য ঘাটতির কোনো শঙ্কা নেই। তবে ধানে প্রভাব না পড়লেও বন্যায় শাকসবজি উৎপাদন কিছুটা কমবে। আমনের বীজতলা এখনো তৈরি শুরু হয়নি। আউশ ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে আউশ উঁচু জমিতে হয়। বন্যা যদি আর না বাড়ে, এখন যে অবস্থায় আছে তাতে ক্ষতি হবে না।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বন্যা যখন শুরু হয়েছে সেই মুহূর্তে তেমন কোনো ফসল মাঠে ছিল না। আমনের বীজতলা এখনও তৈরি শুরু হয়নি। আউশ ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে আউশ উঁচু জমিতে হয়। বন্যা যদি আর না বাড়ে, এখন যে অবস্থায় আছে তাতে ক্ষতি হবে না।
এদিকে বন্যায় শাকসবজির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার কোনো প্রথমিক হিসাব নেই। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এখন সারাদেশে তিন লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি আছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার হেক্টরের। যার মধ্যে গ্রীষ্মকালীন ফসল তিল ও বাদামের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিছু এলাকায় মরিচ নষ্ট হয়েছে। তবে প্রাথমিক পরিসংখ্যান যাই বলুক, বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি বলে মনে করছেন। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অধিকাংশ ফসলের মাঠ ডুবে রয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে মাছের খামার, গোয়ালঘর আর শাকসবজির ক্ষেত। এ অবস্থায় সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ক্ষতির যে প্রাথমিক হিসাব বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন তারা। বন্যায় শুধু খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনটি নয়, প্রচুর পশু মারা যাচ্ছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সঠিক খবরও মিলছে না। পানি থাকা অবস্থায় ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ নিরূপণ করাও সম্ভব নয়।
সুনামগঞ্জের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, শুধু এই জেলায় ১৫ হাজার হেক্টর আউশের ক্ষেত ডুবে গেছে। সাত থেকে আট হাজার হেক্টর সবজির ক্ষেত পানির নিচে। ফলে আউশের বড় ক্ষতি হবে। পানি নামতে বেশি দেরি হলে আমনেরও ক্ষতি হবে। কারণ আমন বীজতলা করার সময় চলে যাচ্ছে, বন্যার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রুস্তম আলী জানান, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি এত খারাপ যে, শুধু খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনটি নয়, প্রচুর পশু মারা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩৭৩টি গরু মরে গেছে বলে জানতে পেরেছি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সঠিক খবরও মিলছে না। পানি থাকা অবস্থায় ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে বন্যার প্রভাব আউশ ছাড়িয়ে আমনে গেলে সেটা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। দেশে উৎপাদনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি হয় বোরো ধান। মোট ধানের প্রায় অর্ধেক আসে বোরো থেকে। প্রতি বছর দেশে ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। আমন আবাদ হয় ৫৭ থেকে ৫৮ লাখ হেক্টরে। আউশ আবাদ হয় ১২ থেকে ১৩ লাখ হেক্টর জমিতে। ফলে আউশ-আমন দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাঘাত হবে সার্বিক খাদ্য উৎপাদনে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, আউশের ক্ষতি হলেও এখনও আমনের ক্ষতির কোনো শঙ্কা নেই। কারণ এখনও আমনের বীজতলা করার সময় রয়েছে। যেখানে আউশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেখানে আমনের আগাম জাতের বীজ দেওয়া হবে।
তিনি জানান, সারাদেশে ১৩ লাখ ৯ হাজার হেক্টর আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা আবাদ করতে পারবো ১২ লাখ হেক্টর পর্যন্ত। আরও কয়েকদিন আউশ আবাদ করা যাবে। এছাড়া আমন আবাদের লক্ষ্য ৫৯ লাখ হেক্টর। কিছু এলাকায় বীজতলা তৈরি শুরু হয়েছে। যেসব এলাকা প্লাবিত রয়েছে, সেখানে বন্যার পরে বীজতলা তৈরির ব্যবস্থা করা হবে।
অন্যদিকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে বন্যা ছড়াচ্ছে মধ্যাঞ্চলে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় মধ্যাঞ্চলের শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ীতে বন্যা দেখা দিতে পারে বলে মঙ্গলবার (২১ জুন) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে।