স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয় শনিবার। অপেক্ষা ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়ার। সেই অপেক্ষায় অবসান ঘটিয়ে রোববার ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে জাজিরা প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলে দেয়া হয়।
নির্ধারিত টোল পরিশোধ করে প্রথম গাড়ি হিসেবে ছেড়ে যায় ফরিদপুরের বাসিন্দা নাজমুস সাকিবের মোটরসাইকেল। এরপর একে একে প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্সসহ অনুমোদিত যানগুলো টোলপ্লাজা পেরিয়ে মাওয়া প্রান্তের দিকে ছুটে চলেছে।
রোববার সকালে আলো ফোটার আগেই জাজিরাপ্রান্তে টোল প্লাজার সামনে দীর্ঘ সারি দেখা গেছে যানবাহনের। গাড়ি নিয়ে কেউ এসেছে শখে, কেউ প্রয়োজনে।
আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়ার পর বাইক নিয়ে সেতু পার হতে ভোর সাড়ে ৪টায় জাজিরাপ্রান্তের টোল প্লাজায় এসে হাজির হন ফরিদপুরের বাসিন্দা নাজমুস সাকিব।
তিনি বলেন, ‘আমার টার্গেট ছিল প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সেতু পার হবো। খবরে জানছিলাম, সকাল ৬টায় পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা খুলে দিবে, সেজন্য মাঝরাত থেকে এখানে এসে অপেক্ষা করছি।’
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রথমবার সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে খুব সকালে আসেন বাগেরহাট-২ (সদর-কচুয়া) আসনের সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়। বাগেরহাট থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে টোল প্লাজায় এসে হাজির হন এই তরুণ সাংসদ।
পদ্মা পাড়ি দিতে যাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই ব্রিজের স্বপ্ন আমাদের পূর্বপুরুষরা দেখে গেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের উপহার দিয়েছেন। আমিতো বাগেরহাট থেকে আসছি, দেড় ঘণ্টার মধ্যে এখানে চলে আসছি। দেখি কতক্ষণ লাগে সেতু পার হতে। এই আবেগের কথা বুঝানোর ভাষা নেই। আমি নিজে গাড়ি চালাচ্ছি, ব্রিজে গাড়ি চালাতে চাই, দেখতে চাই। আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নাই।’
রোগী নিয়ে সেতু পাড়ি দিতে আসা অ্যাম্বুলেন্স চালকরা ভীষণ খুশি। ফরিদপুরের ভাঙা থেকে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে যাচ্ছেন চালক তানভীর হাসান।
তিনি বলেন, ‘আগে ৬-৭ ঘণ্টা লেগে যাইতো ফেরির কারণে। চোখের সামনে গাড়িতে মানুষ মারা যাইতে দেখছি, এই দৃশ্য দেখার কষ্ট অনেক। আজকে পাঁচ মিনিটে পার হয়ে যেতে পারবো, এর চেয়ে খুশির কিছু নেই।’
সব গাড়ি নিয়ে পার হতে পারলেও অনুমোদিত না পাওয়ায় সেতু পাড়ি দিতে পারেননি খুলনার কয়রার বাসিন্দা মিনারুল ইসলাম। তিনি অটোরিক্সায় নৌকার আদলে কাঠামো তৈরি করেন। ঢাকায় বসবাস করা এই ব্যক্তি নৌকার আদলে গাড়ি নিয়ে সমাবেশে এসেছিলেন, দিনভর ছিলেন কাঁঠালবাড়ী এলাকায়। আজ সেতু পাড়ি দেয়ার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু টোলপ্লাজায় তার গাড়ি আটকে দেয়া হয়েছে।
মিনারুল বলেন, ‘কত শখ করে নৌকার মতো গাড়ি বানাইছি। টোলও দিছি কিন্তু যাইতে দিচ্ছে না।’
টোলপ্লাজায় দায়িত্বে থাকা একজন কর্মী জানান,’ উনার গাড়ি অনুমোদিত নয়, আমাদের কোনো ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে না। যে কারণে আমরা উনাকে যেতে দিতে পারছি না।’
সকাল ৫টা ৫০ থেকে ৭টা পর্যন্ত কয়েকশ মোটরসাইকেল জাজিরাপ্রান্ত থেকে টোল পরিশোধ করে পদ্মা সেতুতে উঠে। তাদের অধিকাংশ হেলমেট ব্যবহার করেননি। কোনো মোটরসাইকেলে চালক-আরোহী দুজনেরই হেলমেট নেই, কোনোটাতে চালকের আছে আরোহীর নেই।
জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজায় সেনাবাহিনী, র্যাব, টোল কর্তৃপক্ষ থাকলেও যাত্রী ও চালকের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার এই বিষয়গুলো দেখার কেউ নেই।
ভায়াডাক্টসহ ৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুটির টোল আদায় কার্যক্রম দ্রুতগতি করতে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের দুটি টোলপ্লাজায় বসানো হয়েছে সাতটি করে মোট ১৪টি গেট।
যান চলাচলে সেতুটি খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই প্রান্তের ১৪টি টোল গেট চালু হয়ে গেছে। সব কটি গেটে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর টোল
গত ১৭ মে পদ্মা সেতুর টোল হার প্রকাশ করে সরকার। সে হিসাবে এই সেতু পাড়ি দিতে মোটরসাইকেলকে দিতে হবে ১০০ টাকা।
প্রাইভেট কার ও সাধারণ জিপে টোল ঠিক করা হয়েছে ৭৫০ টাকা। পিকআপ ও বিলাসবহুল জিপ পারাপারে টোল ধরা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা।
মাইক্রোবাস পারাপারে সেতুর টোল ১ হাজার ৩০০ টাকা। ৩১ বা এর কম আসনের ছোট বাসের জন্য দিতে হবে ১ হাজার ৪০০ টাকা। মাঝারি বাসের টোল ২ হাজার টাকা। বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
পাঁচ টনের ট্রাক এই সেতু পাড়ি দিলে গুনতে হবে ১ হাজার ৬০০ টাকা। পাঁচ টন থেকে আট টনের মাঝারি ট্রাকের জন্য দিতে হবে ২ হাজার ১০০ টাকা। আট টন থেকে ১১ টনের মাঝারি ট্রাকের টোল ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
থ্রি এক্সেলের ট্রাক পারাপারে টোল ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। মালবাহী ট্রেইলারের (চার এক্সেল) টোল ৬ হাজার টাকা। চার এক্সেলের ওপরে মালবাহী ট্রেইলারের জন্য প্রতি এক্সেলে দেড় হাজার টাকা যোগ হবে।
বর্তমানে ফেরিতে নদী পারাপারে যে হারে মাশুল দিতে হয়, সেতুতে তা দেড় গুণ বা আশপাশে বাড়ানো হয়েছে।