দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবসায়ীদের কম শুল্কে চাল আমদানির সুযোগ দিয়েছে সরকার। চার দফায় এ পর্যন্ত ৯ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে অনুমতি নিয়ে এখন চাল আনা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, সরকার শুল্ক কমানোর সুবিধা দেওয়ার পরে ভারত চালের দাম বাড়িয়েছে। পাশাপাশি ডলারের মূল্যও বেড়ে গেছে। এ দুই কারণ মিলিয়ে আমদানি করা চাল বাজার পর্যন্ত আনতে যে খরচ হবে, সেটি স্থানীয় বাজারের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে বেশি। এ কারণে চাল আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তারা।
আমদানির অনুমতি পাওয়া কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ভারত এখন প্রতি টন মাঝারি মানের চাল ৪০০ থেকে ৪২০ ডলারে বিক্রি করছে। সরকারের ২৫ শতাংশ শুল্কায়নের পরে যা দাঁড়ায় ৫০০ থেকে ৫২৫ ডলার। অর্থাৎ প্রতি টন চালের দাম টাকার অঙ্কে (৯৮ টাকা ডলার হিসাবে) দাঁড়ায় ৪৯ হাজার থেকে ৫১ হাজার ৪৫০ টাকা। এরপর এলসি প্রসেসিং, পরিবহন খরচ ও অন্যান্য খরচসহ প্রতি টন চালে খরচ হবে আরও ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে দেশের বাজারে এ চালের আমদানি মূল্য হবে ৫৩ থেকে সাড়ে ৫৬ টাকার মতো। কিন্তু দেশের মিলগুলোতে এরচেয়ে কম দামে মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে।
একই হিসেবে সরু মিনিকেট বা নাজিরশাইল চাল আমদানিতে খরচ হবে ৬৫ টাকার বেশি। যেখানে মিলগেটে সরু এসব চাল এখন ৬৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে মোটা চাল। এ ধরনের চাল আমদানি করলে তার খরচ দাঁড়াবে ৪৫ টাকার মধ্যে। দেশের মিলগুলোতে এর চেয়ে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
৪ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি নেওয়া নীলফামারীর শামসুল অটো রাইস মিলের কর্ণধার শামসুল হক বলেন, ভারত মোটা চাল ছাড়া সব চালের দাম বাড়িয়ে রেখেছে। ফলে সেখান থেকে গুটি স্বর্ণা বা স্বর্ণা-৫ ছাড়া অন্য কোনো চাল এনে সুবিধা করা সম্ভব নয়। সে জন্য মোটা চাল আনা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু মোটা চালের আবার উত্তরবঙ্গ ছাড়া চাহিদা কম। সব মিলিয়ে উভয়সংকট তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমদানি পর্যায়ে যে দাম তা পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে হাতবদল হয়ে খুচরা বাজারে আসতে খরচ আরও অনেক বেড়ে যায়। মিলে একই মানের চাল কম দামে পাওয়া গেলে আমদানিকারকরা চাল আনলেও তাদের কাছ থেকে কিনতে চাইবেন না ব্যবসায়ীরা। এসব হিসাব করে আমদানির অনুমতি নিলেও এখনই চাল আনছেন না অনেক ব্যবসায়ী।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে আমদানির তথ্য বিশ্লেষণেও। প্রথম দফায় শুল্ক কমানোর পর বেসরকারি উদ্যোগে চার লাখ নয় হাজার টন চাল আমদানি করতে ৯৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার।
এই অনুমোদনের ভিত্তিতে ৩০ হাজার টন আতপ চাল এবং তিন লাখ ৭৯ হাজার টন সিদ্ধ চাল আগামী ২১ জুলাইয়ের মধ্যে আমদানির এলসি করতে শর্ত দেওয়া হয়। এছাড়া ১১ আগস্টের মধ্যে আমদানি করা এসব চাল বাজারজাত করারও নির্দেশ রয়েছে। অর্থাৎ এলসির সময় শেষ হয়ে এলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত এলসি খোলা হয়নি। আর বাজারজাত করার সময় অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও দেশে চাল এসেছে মাত্র ২ হাজার টনেরও কম।
সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১০০ টন। আর বেনাপোল বন্দর দিয়ে রোববার চাল এসেছে ৫১২ টন।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা যে পরিমাণ আমদানির অনুমতি দিয়েছি, সে পরিমাণ এলসি হচ্ছে না সেটা ঠিক। তবে এখনো সময় আছে। দেখা যাক কী পরিস্থিতি হয়। প্রথম ধাপের সময় রয়েছে আরও কয়েকদিন। অন্যান্য ধাপে বেশ কিছুদিন সময় রয়ে গেছে।
এদিকে আমদানিকারকরা বলছেন, বেসরকারিভাবে যে চাল আমদানি হয় তার ৮০ ভাগেরও বেশি আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং পাকিস্তান থেকেও চাল আমদানির সুযোগ রয়েছে। তবে এসব দেশ থেকে চাল আমদানি করতে হলে পরিবহন খরচ আরও বাড়বে। কারণ এর আগে কার্গো সংকটে পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শহিদুর রহামন পাটোয়ারী ৭ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি নিয়েছেন। কিন্তু এখনো তিনি কোনো এলসি খোলেননি।
তিনি বলেন, গত বছরের এই সময়ে ডলারের বিপরীতে খরচ হয়েছে ৮৪-৮৫ টাকা। এবার সেটা কিনতে হচ্ছে ৯৮ টাকায়। এছাড়া ভারত ছাড়া অন্য দেশে পরিবহন খরচ আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। সেজন্য চালের আমদানি বাড়াতে শুল্ক আরও কমানো দরকার।
তবে এ দাবি নাকচ করে দিয়ে খাদ্য সচিব বলেন, আমরা এ পরিস্থিতি ঠিক মনে করছি। ব্যবসায়ীদের কথায় শুল্ক আরও কমানো যাবে না। প্রয়োজনে আমরা হিসাব করে দেখবো।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এলসি খোলার পর ভারত থেকে চাল আমদানি করা যায় এক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত চাল এসেছে ২ হাজার টনেরও কম। যেখানে প্রথম দফায় যারা অনুমতি পেয়েছেন তাদের আড়াই সপ্তাহ কেটে গেছে।
এদিকে তথ্য বলছে, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবসায়ীদের কম শুল্কে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও এর সুফল বরাবরই পাওয়া যায় না। কারণ গত অর্থবছরের ১৭ আগস্ট থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সংকট কাটাতে ৪১৫টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৭ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসময় চাল আসে মাত্র ৩ লাখ ৩১ হাজার টন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, শুল্ক কমালে ব্যবসায়ীরা চাল আনবেন কি না সেটি তার মজুত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। নিজেদের মজুত চাল থাকলে আমদানির কারণে বাজারে দাম পড়ে যাক সেটা তারা কখনো চাইবেন না। ফলে অনাগ্রহ দেখাবেন। আবার সংকট মোকাবিলার কথা তারা কখনো ভাববেন না, লাভটা আগে হিসাব করবেন। ধান-চালের হিসাব এত সোজা নয়।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের ভরসা করে তাদের মাধ্যমে দাম কমবে- এ ভাবনায় বসে থাকা ঠিক হবে না। তাদের সাপ্লাই বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। তারা মুনাফা ছাড়া কিছুই করেন না। আমদানি সংকট সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে সেটা দেখার বিষয়।