জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনার পথ বের করেছে সরকার। দাম এক লাফে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে আগস্টের শুরু থেকেই এই পথ খুঁজছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য প্রথমেই জ্বালানি তেল আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর কথা ভাবা হচ্ছিল। যতটা শুল্ক কমানো হয়েছে তাতে লিটারে দুই টাকা দাম কমতে পারে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই জ্বালানি তেলের দাম কমানোর উপায় খুঁজতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দেয়।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রস্তাবনা তৈরি করতে ইতোমধ্যে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগের দেয়া ওই নির্দেশনায় আমদানি খাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কতটা কমিয়ে কীভাবে তা জনগণের সহ্যসীমায় রাখা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরতে বলা হয়।’
সরকারের সেই চেষ্টার ফল হিসেবে ডিজেলের আগাম কর প্রত্যাহারের ঘোষণা এসেছে। পাশাপাশি ডিজেলের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে।
রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপিসি ও অন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হ্রাসকৃত শুল্ক হারে ডিজেল আমদানি করতে পারবে।
এতোদিন ডিজেল আমদানিতে ৩৪ শতাংশ শুল্ক ছিল তা এখন কমে ২৯ শতাংশ হলো। এর ফলে বাজারে ডিজেলের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আপাতত দাম কমছে না
শুল্ক কমলেও এখনই দেশের বাজারে কমছে না জ্বালানি তেলের দাম। সেপ্টেম্বর থেকে বিপিসির কেনা তেলে শুল্ক কমায় তখন দাম কমানো হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যতটুকু কর কমেছে, তাতে লিটারে দর কমতে পারে দুই টাকার মতো। এতে বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না। আবার এখন বাজারে যে তেল আছে তা জুলাই ও আগস্ট মাসের কেনা। এ থেকে সরকার প্রয়োজনীয় ভ্যাট ও ট্যাক্স ইতোমধ্যে কেটে নিয়েছে। তাই এই তেল কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই। আমাদের আগামীর অর্ডারের তেল দেশে পৌঁছলে হয়তো দাম কমানো সম্ভব হতে পারে।
‘মূল কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলে বড় ধরনের দর পতন হতে হবে। বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ৭৪ ডলারের নিচে নেমে এলেই কেবল দেশের বাজারে দাম কমানো সম্ভব হবে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পদক্ষেপটি সাময়িক, স্থায়ী কিছু নয়। বিপিসিকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচাতে এটা করতে হয়েছে।’
‘আমরা এটা সমন্বয় করব। সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। সবাই মাথা ঠাণ্ডা রাখলে, ধৈর্য্য ধরলে এই সংকট আমরা সামলাতে পারব।’
কর কমাতে এনবিআরে চিঠি
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির দায় নিজেদের কাঁধে না নিয়ে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর চাপাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি বাবদ উচ্চ হারের ট্যাক্স ও ভ্যাট বাবদ সরকার বড় অংকের রাজস্ব আদায় করে।
জ্বালানি আমদানির ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর মাধ্যমে বিপিসির লোকসান কমাতে ২০২১ সালেই জ্বালানি বিভাগ এনবিআরকে চিঠি দেয়। তাতে বলা হয়, ‘এনবিআর আমদানি ট্যাক্স কমালে বিপিসির লোকসান ঠেকানো যাবে। তেমনি লোকসান এড়াতে মূল্য বাড়ানোর ঝুঁকিও নিতে হবে না। এতে করে জনগণের ওপর বাড়তি দরের চাপ পড়বে না, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
এটি ছিল জ্বালানি বিভাগের ২১তম চিঠি। কিন্তু কোনো কিছুকেই গ্রাহ্য করেনি জাতীয় রাজস্ব বিভাগ। উল্টো যুক্তি হিসেবে রাজস্ব বিভাগ জ্বালানিকে সরকারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আহরণের খাত হিসেবে উল্লেখ করে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ জানিয়েছে, সব ধরনের কর প্রত্যাহার করলে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য কম করে হলেও ৩৬ টাকা কমানো সম্ভব।
ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল ও অকটেন আমদানির ওপর কাস্টমস শুল্ক ও অন্যান্য কর বাবদ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আদায় করে। এর মধ্যে কাস্টমস শুল্ক ১০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ২ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ। এখন ১১৪ টাকার প্রতি লিটার ডিজেল থেকে ৩৬ টাকা কর আদায় করছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘জ্বালানি বিভাগের এই চিঠির কোনো উত্তরই দেয়নি জাতীয় রাজস্ব বিভাগ। উল্টো বিপিসির হিসাবে জমা থাকা উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে নেয় সরকার।
‘এই টাকা না নিলে অন্তত ২১ মাস লোকসান দিয়ে আগের দামেই তেল বিক্রি করতে পারত বিপিসি।’
বিপিসির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে সাত বছরে সংস্থাটি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। আর ২০২০ ও ২০২১ অর্থবছরে সরকারের কোষাগারে ৯ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে বিপিসি।
অবশ্য বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকে ৭ বছর মুনাফা করলেও তার আগের ১৪ বছর টানা লোকসান করেছে বিপিসি। মুনাফার টাকায় সেই বিপুল লোকসানের পুরোটা সমন্বয় করা যায়নি।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা
করোনা-পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতির মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। সেই থেকে দুই দেশের মধ্যে চলছে যুদ্ধ। এর বিরূপ প্রভাব করেছে বিশ্ব জুড়ে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, সার সংগ্রহ করতে দেশে দেশে রিজার্ভ পড়েছে চাপে। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও।
মূল্যস্ফীতি আর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। জ্বালানির দর বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বাড়ছে পণ্যমূল্য। আর্থিক চাপে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে।
তেলের বাড়তি দর সরকারকে রাজনৈতিকভাবেও চাপে ফেলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত সমালোচনার মুখে সরকারের দৃশ্যত কোনো শক্তিশালী জবাব নেই।
উদ্ভূত পরিস্থিতি আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে চাপে ফেলতে পারে- এমন আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই।
সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনার পথ খুঁজছিল। এর অংশ হিসেবে কমানো হয়েছে জ্বালানি তেল আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট।