ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ সাড়ে তিন মাসে (১ জুলাই থেকে ১৬ অক্টোবর) ব্যাংক থেকে সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত বছরের একই সময়ে নিয়েছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো।
অথচ গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত যেখানে ৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা কম ছিল। এর মানে সরকারের ঋণ ওই পরিমাণ ঋণাত্মক ছিল। অর্থাৎ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি শোধ করেছিল।
রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে আসায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। এ ছাড়া আমদানি এবং সুদ পরিশোধসহ অন্যান্য খাতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঋণ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।
চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রথম দুই মাসে পেয়েছে মাত্র ৪০১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগস্ট পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। আর ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণস্থিতি রয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। এ ঋণের বিপরীতে সরকারের প্রচুর সুদ দিতে হচ্ছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ সাড়ে তিন মাসে (১ জুলাই থেকে ১৬ অক্টোবর) ব্যাংক থেকে সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত বছরের একই সময়ে নিয়েছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের প্রায় সবই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে গত অর্থবছরের তুলনায় ঋণ কমেছে ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এ হিসাবেই ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে অন্যান্য পণ্যের দর বৃদ্ধির প্রভাবও সরকারি কেনাকাটায় পড়েছে। সেই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ার কারণেও সরকারের ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় সে হারে বাড়ছে না। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে কিছুটা বাড়লেও সেপ্টেম্বরে কমেছে। আবার ব্যাংকের বাইরে সঞ্চয়পত্র থেকেও সেভাবে ঋণ পাচ্ছে না সরকার। যে কারণে ব্যয় সংকোচন নীতির মধ্যেও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে।’
রাজস্ব আয়ে হোঁচট
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব আয়ে উল্লম্ফন হলেও সেপ্টেম্বরে তা কমে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে ছন্দঃপতন ঘটেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেপ্টেম্বর শেষে সেই প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরের এই তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায় বেড়েছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। সে তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আয়ে ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই-আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমদানি কমে আসায় রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট আহরণে তার প্রভাব পড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে ছন্দঃপতন ঘটেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আয়ে এবার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে কমপক্ষে ৩১ শতাংশ। যদিও এই লক্ষ্যমাত্রা অত্যন্ত ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে। সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে মাত্র ৮ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই আগস্টের চেয়ে গত বছরের আগস্টে ৪৪৯ গুণ বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, এই বছরের জুলাইয়ের চেয়ে গত বছরের জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র খাতে সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
আর অর্থবছরের দুই মাসের হিসাবে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৪০১ কোটি ২০ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৭৩২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ের চেয়ে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সঞ্চয়পত্রে ১৪ দশমিক ২৯ গুণ বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
আহসান মনসুর বলেন, ‘বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেও খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে।’
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি।
সবশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পরও বিক্রি বাড়ছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে বিক্রি বেশ কমেছে। এখন একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, ‘এমনিতেই দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। এই ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাজারে জিনিপত্রের দাম বেশি ছিল। এরপর যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে গেছে।’
‘এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) গত সেপ্টেম্বর মাসে সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। আগস্টে এই হার ছিল আরও বেশি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে মজুরি সূচক ছিল ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
বিবিএসের এই তথ্যই বলছে, দেশের মানুষ যা আয় করছে, তা তার সংসারই চলছে না; সঞ্চয় করবে কিভাবে?
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে গ্রাহকদের মূল টাকা (বিনিয়োগ) ও মুনাফা (সুদ) বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকারকে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫২ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যের চেয়ে এই খাত থেকে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কম ঋণ নিয়েছে সরকার।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৭০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়। সে হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে, ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।