১৯ ফেব্রুয়ারি হতে যাওয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক মহল, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। গত ২৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ পদে ভোটের তফসিল ঘোষণার পর এই আলোচনা আরও বাড়তে থাকে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নাম চূড়ান্ত করতে কাজ করছেন। দ্রুতই দলের সংসদীয় বৈঠকে এ পদে মনোনীত ব্যক্তির নাম ঘোষণা করা হবে। কিন্তু কোনো পর্যায়ের নেতাই নির্দিষ্ট করে এ পদের জন্য একজনের নাম নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, রাষ্ট্রপতি পদে এখন পর্যন্ত আলোচনায় আছেন প্রধানমন্ত্রীর অথনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেন এবং সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তবে বরাবরের মতো এ পদেও চমক থাকতে পারে বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেবে। একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির দক্ষ, সাহসী, মেধাবী ও পরীক্ষিত ব্যক্তিই প্রাধান্য পাবেন।’
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার পদ থেকে অবসরে যাচ্ছেন আগামী এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে। সংবিধান অনুযায়ী তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কেননা সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান আছে।এ বাধ্যবাধকতার আলোকে প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে এ পদে নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছেন।
যেহেতু এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, তাই ধরে নেয়া হয়, এই দলের মনোনীত কেউই হবেন নতুন রাষ্ট্রপতি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী ভোটাভুটিতে পাস করতে পারবেন না।
অবশ্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এ নিয়ে দুই মেয়াদ পার করতে যাচ্ছেন। দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধার কারণে তিনি আর পদে আসতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে নতুন কাউকে এ পদে নির্বাচিত করতে হবে।
আর রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে এমন কাউকেই এ পদে দলটি আনতে চায় যিনি হবেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কমুক্ত। কেননা নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়াত সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া থাকতে মনে করা হচ্ছিল এদের দুজনের কেউ-ই হবেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাদের মৃত্যুতে এ পদে অন্য নামগুলো চলে এসেছে।
প্রথম দিকে আলোচনায় থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী সংসদ উপনেতা হয়েছেন। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই তার অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
গত কয়েকদিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে জোর গুজব ড. মসিউর রহমান এ পদে এগিয়ে আছেন। কিন্তু তাকে নিয়েই দলের মধ্যে রয়েছে জোর আপত্তি। প্রথমত, তিনি শারীরিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলছেন, সম্প্রতি তার স্ত্রী মারা যাওয়ায় তার মানসিক অবস্থাও ভালো না।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কোনো আমলাকে এ পদে চান না। তাদের মতে, একজন আমলার চেয়ে একজন রাজনীতিবিদকে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দেয়া ভালো হবে। তারপরও মসিউর রহমানের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কারণে তিনি এগিয়ে থাকছেন।
এ পদে নতুন করে যে নাম এসেছে তিনি হলেন দিনাজপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী। তিনি আমলা থেকে একজন পরীক্ষিত রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতিতে তার কোনো বিচ্যুতি নেই বলেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মনে করছেন।
রাষ্ট্রপতি পদে যার নাম সবসময়ই জোরের সঙ্গে আলোচনায় আছে তিনি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত। কিন্তু তিনি যত শক্ত হাতে এবং সুশৃঙ্খলভাবে সংসদ পরিচালনা করেছেন, তাকে রাষ্ট্রপতি করলে তার শুন্য পদে বিকল্প কেউ নেই।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের রাষ্ট্রপতি হবার ক্ষেত্রে একটিই প্রতিবন্ধকতা, তার বয়স। তাছাড়া তিনি জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পাননি। চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত।
এছাড়া আ ক ম মোজাম্মেল হকের ক্ষেত্রেও বয়স এবং তার অবর্তমানের মন্ত্রণালয় চালানোর বলিষ্ঠ মানুষ খোঁজার বিষয় আছে।
এদের বাইরে সাবে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও রাষ্ট্রপতি পদে আলোচনায় আছেন।
আবদুল হামিদ প্রথম দফায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২৪ এপ্রিলের মধ্যেই ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নতুন কারও শপথ নেওয়ার কথা।
রাষ্ট্রপতি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন না। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের ভোটে। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে হলে সংসদ সদস্য হতে হয় না। তবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে প্রস্তাবক এবং একজনকে সমর্থক হতে হবে। ক্ষমতাসীন দল তাদের আস্থাভাজন ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়।
সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ ৩৫০টি আসনের মধ্যে ৩০২টি আওয়ামী লীগের। জাতীয় পার্টির ২৬টি, ওয়ার্কার্স পার্টির ৪টি, জাসদের ২টি, বিকল্পধারার ২টি, গণফোরামের ২টি, তরীকত ফেডারেশনের ১টি, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১টি এবং স্বতন্ত্র ৩টি আসন। বিএনপির সাতজন পদত্যাগ করায় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই।
সূত্রঃ এনবি24