একসময় সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহ ছিল মানুষের। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের আস্থার জায়গা ছিল এটি। চাকরি থেকে অবসরের পর পাওয়া অর্থ বা বাড়তি টাকা থাকলে সেগুলো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতো। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। তলানিতে ঠেকেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর ২০২২-২৩ এর প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। বিক্রির পরিমাণ এত তলানিতে যে, বিক্রির টাকা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করাও সম্ভব হয়নি। এমনকি বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাও হয়নি পূরণ। এরমধ্যে প্রথম ছয় মাসে এ খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার।
আলোচিত ৯ মাসে ৬২ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর সরকার এই খাতের মোট পরিশোধ করেছে ৬৬ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে আরও ৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার বা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এখন সঞ্চয়পত্রে কিছুটা কড়াকড়ি রয়েছে। সুদহার কমিয়েছে সরকার। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে।
গত মার্চ মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকার। তবে সরকারকে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে পরিশোধ হয়েছে ৬৫২ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের একই সময়ে (২০২২ সালের মার্চ) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা নির্ভর হয়েছে সরকার।এজন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার ঋণ।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ বেশি হয়েছে। প্রথম মাস জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ৩৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক ৪৪০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ছিল, নভেম্বরে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল ৯৮৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, অক্টোবরে নিট বিক্রি ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা, এবং সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল ৭০ কোটি ৬৩ হাজার টাকা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা ইতিবাচক ছিল। এরমধ্যে গত আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল আট কোটি টাকা। আর জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি টাকা ছিল।
গত অর্থবছরেও এ খাত থেকে কম ঋণ পেয়েছিল সরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ আসে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। অথচ করোনাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে মোট ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়ায়, ব্যাংক থেকে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ নেওয়া লাগতে পারে। ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকায় অভ্যন্তরীণ ঋণের পুরোটাই এখন যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫০ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার বেশি, আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ ছিল। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।