শিরোনাম :

জলাবদ্ধতা: বন্দর নগরীতে প্রতি পদে বিপদের শঙ্কা

জলাবদ্ধতা: বন্দর নগরীতে প্রতি পদে বিপদের শঙ্কা
Admin

বন্দর নগরীর কালু্রঘাট বিসিক শিল্প এলাকা থেকে রোববার মুরাদপুরে অফিসে যাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী পারভেজ উদ্দিন। সকাল ৭টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন সড়কে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি।

জলাবদ্ধতার কারণে কমে গেছে সড়কে গণপরিবহন চলাচল। অনেক কষ্টে একটি অটোরিকশাকে রাজি করিয়ে আরেক যাত্রীসহ চান্দগাঁও থানার সিএন্ডবি মোড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। পথে একটি ট্রাককে জায়গা করে দিতে গিয়ে তাদের বহনকারী অটোরিকশাটি পড়ে যায় সড়কের পাশে থাকা উন্মুক্ত নালায়।

চালকসহ তিনজনই সামান্য আহত হন। তবে পারভেজের মোবাইল ফোন সেট ও মানিব্যাগ নালায় হারিয়ে যায়। স্থানীয়দের সহায়তায় আধ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে নালা থেকে মোবাইল ও মানিব্যাগ খুঁজে বের করেন তিনি।

পারভেজ বলেন, ‘মূলত একটি ট্রাককে জায়গা করে দিতে গিয়ে অটোরিকশা চালক সড়কের এক পাশে চলে যান। পানির কারণে সড়ক আর নালা আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। তখন পানি বেশি থাকায় ট্রাকের কারণে পানির ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। সেই ঢেউয়ে রিকশাটি উল্টে নালায় পড়ে।’

মুরাদপুর এলাকায় শনিবারও একইভাবে নালায় পড়ে আহত হন এক শিক্ষীর্থ। সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় জলাবদ্ধতার কারণে উন্মুক্ত নালা চিহ্নিত করতে পারেননি তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী মো. নুরুর আজিম বলেন, ‘আমি ফোন দিয়ে পানির ভিডিও করার সময় দেখি একটা ছেলে ফুটপাতের পাশে নালায় হঠাৎ পড়ে গেছে। তবে তার খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, নিজে নিজেই উঠে চলে গেছে। পানি থাকায় অনেকে নালা ও সড়ক চিহ্নিত করতে পারছে না।’

টানা বৃষ্টিতে গেল চারদিন ধরে জলাবদ্ধ বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নিচু এলাকা। বুধবার শুরু হওয়া বৃষ্টিতে শুক্রবার থেকে পানি জমতে শুরু করে নগরীর নিচু এলাকায়। ওইদিন থেকে জলাবদ্ধ রয়েছে নগরীর বাকলিয়া, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, পাহাড়তলী, ইপিজেড, আগ্রাবাদ, ফিরিঙ্গিবাজার, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার পরিবার। কয়েক হাজার বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে বাসিন্দাদের।

জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের পাশাপাশি নগরীর বাসিন্দাদের যেন প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বিপদ। এদিকে যেমন পথ চলতে গিয়ে নালায় পড়ার ভয়, অন্যদিকে আছে বিদ্যুতায়িত হওয়ার শঙ্কাও। তাছাড়া জমে থাকা পানি নোংরা হওয়ায় সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন নানা চর্মরোগেও।

নগরী বিভিন্ন স্থানে মূল সড়কের পাশে রয়েছে উন্মুক্ত নালা। তাছাড়া বিভিন্ন সড়কে পথচারীদের চলাচলের জন্য নির্ধারিত ফুটপাতে থাকা ড্রেনের কোথাও কোথাও স্ল্যাব না থাকায় উন্মুক্ত হয়ে আছে। জলাবদ্ধতার কারণে এসব চিহ্নিত করতে পারছেন না পথচারীরাও। তাই যে কোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

মাত্র দুই বছর আগে মুরাদপুরে উন্মুক্ত নালায় পড়ে তলিয়ে যান সবজি ব্যবসায়ী মো. সালেহ। দুই আজও সন্ধান পাওয়া যায়নি তার। ওই একই বছর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নালায় পড়ে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ প্রাণ হারান ৫ জন। সে সময় সিটি মেয়র নগরীর সব উন্মুক্ত নালায় স্ল্যাব বসানোর ঘোষণা দিলেও তার বাস্তবায়ন ঘটেনি।

বিদ্যুৎ থেকেও যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ২০২১ সালে নগরীর কাতালগঞ্জ এলাকায় একটি জলাবদ্ধ ভবনে পানির মোটর চালু করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারান দুজন। এর পরের বছর জলাবদ্ধতার সময়ে বিদ্যুৎ থেকে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

অবশ্য নগরীর জলাবদ্ধ হয়ে থাকা এলাকায় দুর্ঘটনা রোধে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (চট্টগ্রাম) প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম।

অন্যদিকে বৃষ্টির পানি নালা ও ড্রেনের নোংরা পানির সঙ্গে মেশায় সড়ক ও বাসাবাড়িতে প্রবেশ করা এই পানির সংস্পর্শে নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বহির্বিভাগের চিকিৎসক ডা. ইসরাত জাহান বলেন, ‘এসব পানিতে যে জীবাণু রয়েছে তা থেকে বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ হতে পারে। এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়াল (খোসপাঁচড়া) ও পাঙ্গাল (ছত্রাক) ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা বেশি।’

জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের অন্যতম বড় সমস্যা। কয়েক দশক ধরেই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে চলছে নগরবাসী। জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার চারটি বড় সরকারি প্রকল্প চলছে বছরের পর বছর। এই চার প্রকল্পের প্রতিটিরই সময় ও ব্যয় বাড়লেও সুফল কবে মিলবে বলা দুষ্কর।

বড় চার প্রকল্পের মধ্যে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হাতে। ২০২১ সালে প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। সিডিএ ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে আরেকটি বড় প্রকল্প ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ও রয়েছে সিডিএ’র হাতে। ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ এই প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

এই দুই প্রকল্পের বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পে ২১টি খাল খনন শেষ হয়েছে। বাকিগুলো ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যার জন্য করা সম্ভব হয়নি। অধিগ্রহণের টাকা পেলেই আমরা কাজটা শেষ করে ফেলতে পারব।

‘আর কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পেরও অধিকাংশ কাজ শেষ। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এই প্রকল্পের স্লুইস গেটের গেটগুলো মরিচারোধক স্টিল দিয়ে দিতে হবে, যা নেদারল্যান্ডস থেকে আনতে হচ্ছে। আগামী দেড় বছরের মধ্যে এটার কাজও শেষ হয়ে যাবে।’

তবে এই কর্মকর্তার মতে, চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ইপাড়া খাল খনন শেষ না হওয়া এবং যথাযথ ময়লা ব্যবস্থাপনা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার অভাব।

তিনি বলেন, ‘নগরীর মাত্র ১০ শতাংশ ময়লা সংগ্রহ করা হয়, বাকি সব নালা ও খালে যায়। এতে নালা ও খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। তাছাড়া শহরের পানি কর্ণফুলীতে নামে চাক্তাই খাল হয়ে। কিন্তু এত বড় শহরের পানি নিষ্কাশনে চাক্তাই খাল যথেষ্ট নয়। সেজন্য সিডিএ’র মাস্টারপ্ল্যানে বাড়াইপাড়া খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। খালটি এখনও খনন করা যায়নি বলে পানি যেতে দেরি হয়।

‘সবচেয়ে বড় কথা, নগরীর ১৪ শ’ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে মাত্র ৩ শ’ কিলোমিটার নিয়ে আমরা কাজ করছি। বাকি ১১ শ’ কিলোমিটার সিটি করপোরেশনের অধীনে। তারা এগুলোতে পানি প্রবাহের পরিবেশ রাখে?’

চট্টগ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত চার বছরে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্প কাজের মাত্র ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বর্তমানে নানা জটিলতায় আটকে আছে প্রকল্পটির কাজ।

এ ছাড়াও সিটি করপোরেশনের হাতে রয়েছে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প। সময় বাড়ানোর পরও এই প্রকল্পের মেয়াদ আছে আর ১০ মাসের মতো। অথচ প্রকল্পে ৫০ শতাংশেরও বেশি কাজ এখনও বাকি।

তথ্যসূত্রঃ নিউজবাংলা24