রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করা হবে শনিবার।
এ টার্মিনালের অবকাঠামো নির্মাণকাজের বেশিরভাগই শেষ হয়ে এসেছে। দৃশ্যমান হয়েছে দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল ভবন ও কার পার্কিং ভবন। বাকি কাজ সমাপ্ত করতে দিন-রাত নিরলস কাজ করে চলেছেন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক।
নবনির্মিত থার্ড টার্মিনালে এরই মধ্যে লিফট, এসকেলেটর, ইমিগ্রেশন বুথ, দৃষ্টিনন্দন সিলিং, গ্লাস ও টাইলস ফিটিংয়ের কাজও প্রায় শেষ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থার্ড টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করবেন শনিবার। আজ এ টার্মিনাল ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।
বড় পরিসর ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন তৃতীয় টার্মিনাল থেকে পুরোপুরি সুবিধা পেতে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত। তখন এই টার্মিনাল দেশের এভিয়েশন খাতে নতুন দুয়ার উন্মোচন করবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, টার্মিনাল ভবনটির নকশা করেছেন সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের নকশাকার রোহানি বাহারিন। তিনি চাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৩ ছাড়াও চীনের গুয়াংজুর এটিসি টাওয়ার, ভারতের আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের নকশা তৈরি করেছেন।
শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। তিন তলাবিশিষ্ট এই টার্মিনালে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, তবে উদ্বোধনের সময় ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ চালু করা হবে। বহির্গমনের জন্য ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার থাকবে। এর মধ্যে ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টার।
এ ছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টারসহ বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৬টি। আর আগমনীর ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার থাকবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরে বিদ্যমান দুই টার্মিনাল মিলে লাগেজ বেল্ট আছে আটটি। সেখানে তৃতীয় টার্মিনালে আগমনী যাত্রীদের জন্য থাকছে ১৬টি লাগেজ বেল্ট। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকছে চারটি আলাদা বেল্ট।
তৃতীয় টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে। এ ছাড়া থাকছে এক হাজার ৪৪টি গাড়ি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বহুতল কার পার্কিং।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে (টার্মিনাল-১ ও ২) বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয়া সম্ভব হয়। সেখানে তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরও ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। সব মিলিয়ে তখন বছরে প্রায় ২ কোটি যাত্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবেন।
পুরোনো টার্মিনালের অ্যাপ্রোনে বর্তমানে ২৯টি বিমান রাখা যায়। সফট ওপেনিংয়ের পর তৃতীয় টার্মিনালের অ্যাপ্রোনে আরও ১০টি বিমান পার্ক করা যাবে।
তৃতীয় টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, নিচতলায় রয়েছে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যান্টিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। তৃতীয় তলায় রাখা হয়েছে আগমনী ও বহির্গামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, চেক-ইন কাউন্টার ও সিকিউরিটি সিস্টেম।
তৃতীয় টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ভিভিআইপি এবং ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা থাকছে। ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য বিশাল লাউঞ্জ করা হচ্ছে নতুন টার্মিনালে। ৪০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের প্রধান বহির্গমন লাউঞ্জ ব্যবহার করবেন ট্রানজিট যাত্রীরা, তবে পুরোনো দুটি টার্মিনালের সঙ্গে নতুন টার্মিনালের সংযোগ থাকবে না এখন। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন ও পুরোনো টার্মিনালের মধ্যে করিডোর নির্মাণ হবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, কিছু কিছু কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। রানওয়ের সঙ্গে অ্যাপ্রোনের সংযোগ হয়ে গেছে। এক্সপোর্ট এবং কার্গো টার্মিনালও হয়ে গেছে। প্রধান ভবনের ফিজিক্যাল স্ট্রাকচারের কাজগুলোও শেষ। উদ্বোধনের আগে আরও অনেকটা কাজ শেষ হয়ে গেছে।
মফিদুর রহমান বলেন, ‘এই সফট ওপেনিংয়ের পর আরও কিছু কাজ বাকি থাকবে। এই যেমন ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম, ফায়ার সিস্টেম ও বিভিন্ন প্রযুক্তির সিস্টেম ইনস্টল করা। এখানে যারা কাজ করবেন, তাদের ট্রেনিংসহ আরও কিছু কাজ রয়েছে। এসব কিছু শেষ করে আশা করছি ২০২৪ সালের শেষের দিকে তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হবে।
‘এটি হবে একটি আধুনিক টার্মিনাল। এখানে যাত্রীরা উন্নত বিশ্বের সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাবে। এখানে সব কিছুতে আধুনিক অটোমেটেড সিস্টেম থাকবে।’
রাজধানীর মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, হাইওয়ে, রেল স্টেশন- সব মাধ্যমে অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংযোগ থাকছে এই তৃতীয় টার্মিনালে। যাত্রীরা এসব মাধ্যম ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে যাতায়াত করতে পারবেন।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় ২০১৭ সালে। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় একনেক। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্মাণকাজে অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বৃহৎ এই থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে আরও ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়।
তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো জাপানের মিতসুবিশি করপোরেশন, ফুজিতা করপোরেশন ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি।
এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয় ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ বাস্তবায়নের মেয়াদ ৪৮ মাস। এতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। বাকি টাকার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
তথ্যসূত্রঃ নিউজবাংলা24