শিরোনাম :

প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন ঝুঁকি বাড়ায়

প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন ঝুঁকি বাড়ায়
Admin

রক্তের বিকল্প রক্তই। সময়ে রক্ত পরিসঞ্চালন জীবন বাঁচায় অনেক মানুষের। তবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালনে ঝুঁকিতে পড়তে পারে মানুষের জীবন। চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানের পাশাপাশি নিরাপদ রক্তদানের পূর্বে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নিতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের ঝুঁকি যেমন- হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি এইডসসহ প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন রক্তগ্রহীতারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে গত তিন বছরে বিভাগ ও জেলা সরকারি হাসপাতালের রক্তপরিসঞ্চালন কেন্দ্রে (ব্লাড ব্যাংক) ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৭ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়েছে। এসময় ১৩৯ জনের দেহে প্রাণঘাতি এইচআইভি এইডস ভাইরাস শনাক্ত হয়।

নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালা অনুয়ায়ী, রক্তবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে প্রতি বছর রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রক্ত সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত রি-এজেন্ট, কিটস, ফিজার রক্তের ব্যাগ সরকার সরবরাহ করবে। এজন্য আলাদা বরাদ্দ থাকার কথা। তবে গত বছর এই খাতে বরাদ্দ রাখেনি সরকার।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেমেন্ট শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আতাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি কেনাকাটা এক বছর বন্ধ থাকায় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বরাদ্দও এক বছর বন্ধ ছিল। তবে এবছর থেকেই এই খাতে আবার বরাদ্দ আশা করছি, ফলে এবছর আর সংকট থাকবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক. ডা. আসাদুল ইসলাম জানান, রক্তদানের বিকল্প নেই। কারণ রোগীর অস্ত্রোপচার, ট্রমা, দুর্ঘটনা, সন্তান প্রসব, শরীরে হিমোগ্লোবিন ও আয়োডিন কমে গেলে রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্ত নেওয়ার পূর্বে আইন অনুযায়ী পাঁচ ধরনের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে দেশব্যাপী ব্লাড ব্যাগ, কিটস এবং রি-এজেন্টের সংকটের কারণে রক্তের গ্রাহকরা নিজের অর্থায়নে ব্যাগ ও কিট কিনে নিচ্ছে। রক্তদানের আগে যে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা, সেটাও অধিকাংশ সেন্টারে করা হচ্ছে না। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

‘এছাড়াও বিদেশের মতো সেন্ট্রালি ব্লাড সংগ্রহ করে ব্লাড ব্যাংকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ত পরিসঞ্চলণের পূর্বে সঠিক মানের রি-এজেন্ট ও নির্ধারিত ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।’ যোগ করেন তিনি। রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শও দেন এই চিকিৎসক।

রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত গ্রহণ নিরাপদ নয়। এরা অনেক সময় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা না করেই রক্ত নিয়ে থাকে। এছাড়াও রোগীদের জিম্মি করে অনেক সময় বাড়তি টাকায় রক্ত বিক্রি করে। সরকারি হাসপাতালের বাইরে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, কেয়ান্টাম, সন্ধানী, বাঁধন, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন ও থ্যালাসেমিয়া সমিতিসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমোদিত ১৬২টি বৈধ বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানেও একাধিক অবৈধ ব্লাড ব্যাংক সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার তথ্যমতে, দেশে অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত লাগে। সারাদেশে সরকারিভাবে ২২৩টি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৯৯টি, ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ারের ১২৪টি সরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে।

এর মধ্যে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও বিশেষায়িত ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের স্ক্রিনিং করে ২০১৯ সালে ৬৪ জন, ২০২০ সালে ৪৭ জন এবং ২০২১ সালে ২৮ জনসহ তিন বছরে ১৩৯ জনের এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়। একই সময়ে ১৬ হাজার ৯১০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হেপাটাইটিস-বি ও ৮৪৭ জন হেপাইটিস-সি ভাইরাস শনাক্ত হয়। এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে ২ হাজার ২১২ জন রক্তদাতার যৌনবাহিত সিফিলিস রোগ ধরা পড়ে।

স্বেচ্ছায় রক্তদানে নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের তথ্যমতে , গত বছর সরকারি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদাতাদের মধ্যে ২৭ দশমিক ১৯ শতাংশ স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। বাকি ৭২ দশমিক ৮১ শতাংশ রক্তদাতা রোগীর স্বজনেরা। তবে দেশে নারীদের মধ্যে রক্ত দেওয়ার সুযোগ ও প্রবণতা কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে রক্তদাতাদের মধ্যে কেবল ৬ শতাংশ হচ্ছেন নারী।

সরকারের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির হিসাবে, ২০১৯ সালে সারাদেশে ৯ লাখ ৪১ হাজার ১৭২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে গ্রহীতাদের দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে তা কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ ব্যাগে। এছাড়া গত বছর ৭ লাখ ৭১ হাজার ৭০৮ ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চলন করা হয়েছে। এই রক্তদাতাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই পুরুষ।

মঙ্গলবার (১৪ জুন) (বিশ্ব রক্তদাতা দিবস)। বিশ্বে প্রতি বছর এদিনে পালিত হয় দিবসটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিনটির স্লোগান নির্ধারণ করেছে ‘ডোনেটিং ব্লাড ইজ অ্যান অ্যাক্ট অব সোলিডারিটি, জয়েন দ্য ইফোর্ট অ্যান্ড সেভ লাইভ’ অর্থাৎ রক্তদান একটি সম্মিলিত প্রয়াস, এই প্রয়াসে সংযুক্ত হন, রক্তদান করুন ও জীবন বাঁচান।

দিবসটি উদযাপনে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।