ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ি ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকার দুই সিটিতে বর্ষা-পরবর্তী এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডে বর্ষা পরবর্তী লার্ভা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। উত্তর সিটির ৪০টি ও দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডে মোট ৩ হাজার ২৮৩টি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি।
রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ২০২২ সালের বর্ষা-পরবর্তী জরিপে উত্তরে শতকরা ৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় হার ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীটের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। সে হিসাবে গত বছরের বর্ষা পরবর্তী সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্স বা বিআই সূচকের মাধ্যমে। বিআই প্রতি এক শ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা যায়। আর হাউজ ইনডেক্স যদি প্রতি এক শ প্রজনন উৎসের ১০টি হয় তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ষা-পরবর্তী এ জরিপে উত্তর সিটির ১৩ দশমিক ৪ ও দক্ষিণের ১৪ দশমিক ৬ বিআই পাওয়া গেছে। উত্তরে সবোর্চ্চ বিআই ছিল ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও দক্ষিণে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিআই পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৫৮ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছর। এ বয়সে ডেঙ্গুতে মারা গেছে মোট মৃত্যুর ৪১ শতাংশ। যাদের বেশিরভাগই কর্মজীবী ছিলেন।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী ও ৬০ শতাংশ পুরুষ ছিল। আর মৃতদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী, ৪৩ শতাংশ পুরুষ ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৩৪ শতাংশ ঢাকায় চিকিৎসা নিয়েছে, ৬৬ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ ও বরিশাল জেলায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘গত বছর বর্ষা পরবর্তী সময়ে মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। তাই পরবর্তী বছর অর্থাৎ এ বছরেও একই প্রভাব ফেলবে। সে কারণে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সব জায়গায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য এ বছর ডেঙ্গু যেন বড় আকারে প্রভাব ফেলতে না পারে, সেজন্য এখনই একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেটি বাস্তবায়নের জোর দিতে হবে।
‘সেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
ডেঙ্গু বিস্তারের সাধারণ সময় তো আগস্ট এর শুরুর দিকে। কিন্তু গত বছর প্রায় সারা মাসই এর প্রকোপ ছিল। এবারও সেই সম্ভাবনা আছে কি না, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সাধারণত আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এই তিনমাস ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে, তবে এবছরও খারাপ পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ মশার যে ঘনত্ব আমরা দেখছি, যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি। তাহলে ২০২৪ সালও আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ।’
গত শতাব্দীর ৬০ দশকে এই ভূখণ্ডে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সে সময় একে ‘ঢাকা ফিভার’ নাম দেয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত সবোর্চ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে ২০২৩ সালে। এর আগে, সবোর্চ্চ মৃত্যু হয় ২০২২ সালে ২৮১ জন, আর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রথমবার এক লাখ ছাড়ায়। সে বছর ভর্তি হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
মাসের হিসেবে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মৃত্যু হয়েছে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, মার্চে কোনো মৃত্যু হয়নি, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ২ জন, জুনে ৩৪ জন, জুলাইয়ে ২০৪ জন, অগাস্টে ৩৪২ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৯৬ জন, অক্টোবরে ৩৫৯ জন , নভেম্বরের ২৭৪ জন ও ডিসেম্বরে এ পর্যন্ত ৮৩ মৃত্যু হয়েছে।
একই বছরের জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে এক হাজার ৩৬ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৭৬ জন, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন, অক্টোবরে ৬৭ হাজার ৭৬৯ জন, নভেম্বর মাসে ৪০ হাজার ৭১৬ জন ও ডিসেম্বরের ৯ হাজার ২৮৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।