শিরোনাম :

অনাবৃষ্টিতে ভারী হচ্ছে আমন চাষির খরচের বোঝা

অনাবৃষ্টিতে ভারী হচ্ছে আমন চাষির খরচের বোঝা
Admin

দেশের উত্তরাঞ্চলকে বলা হয়ে থাকে শষ্যভাণ্ডার। এই বিশাল উর্বর এলাকা থেকে দেশের খাদ্য চাহিদার বড় অংশের যোগান আসে। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনে এই অঞ্চলের আবাদে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে গণ্য করা হয় বগুড়াকে। এখানকার মাটি ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। সে সুবাদে এখানকার কৃষকরাও এই সুযোগটাকে ফসল উৎপাদনে কাজে লাগান ব্যাপকভাবে।

শঙ্কার বিষয় হলো, গত ৫ বছরে বগুড়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। ফলে বিনা সেচের ফসল আমন ধানের আবাদে পাল্টে গেছে জেলার কৃষির চিত্র। অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধানের আবাদ করতে গিয়েও কৃষককে নির্ভর করতে হচ্ছে সেচের ওপর। আর সেচযন্ত্রে পানি সরবরাহ করতে গিয়ে কৃষকের ঘাড়ে চেপেছে বাড়তি খরচের বোঝা। অনেক এলাকায় সেচের বিনিময়ে উৎপাদিত ধানের বড় একটা অংশই দিয়ে দিতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টি কম হওয়ায় এবার আমন চাষে পানির জন্য উত্তরের প্রবেশদ্বার বগুড়ার চাষীদের পুরোপুরি সেচযন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কৃষি অফিস ও কৃষকদের তথ্যমতে, গড় হিসাবে জেলায় শুধু ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রের পেছনে আমন চাষে খরচ হবে কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা।

আমন ধান বর্ষা মৌসুমের ফসল। এতে প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। আর রোপা আমন চাষের মূল সময় ১৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট। অর্থাৎ ভরা বর্ষার সময়টাতেই আমন ধান রোপণ হয়ে থাকে। কিন্তু এবার ভরা বর্ষায়ও গ্রীষ্মের আবহ। এর বিরূপ প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়েছে কৃষকদের জীবিকায়।

সেচের মাধ্যমে আমন চাষ করছেন ধুনটের নিমগাছি ইউনিয়নের বেড়েরবাড়ি এলাকার কৃষক আবু সাঈদ। তার মতো এলাকার অন্তত ২০০ কৃষক ডিজেলচালিত ১৫টি মেশিনের মাধ্যমে সেচের আওতায় চাষাবাদ করেন। জমি রয়েছে প্রায় আড়াইশ’ বিঘা। প্রথমে এলাকার সেচমালিকরা পানির বিনিময়ে বিঘা প্রতি উৎপাদিত ধানের ২ আনা (১৬ ভাগের দুই ভাগ) চেয়েছিলেন। পরে বর্ষার পরিস্থিতি বুঝে দুই থেকে বাড়িয়ে তিন আনা দাবি করেন।

আবু সাঈদ বলেন, ‘আমন ধান মূলত বর্ষার পানিতে হয়। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত বৃষ্টির দেখা নেই। এ কারণে ২ থেকে ৩ আনা পরিমাণ ধানের বিনিময়ে কৃষকরা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে জমিতে সেচ নিচ্ছেন। অনেকে আবার আমনের আবাদ করবেন কি না তা নিয়েই দোটানায় আছেন।

শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের ইউনুছ আলী দুই বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করবেন। নিজের ছোট একটি শ্যালো মেশিন থাকার সুবাদে তিনি আমন চাষের সাহস করেছেন। এই কৃষক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পানি সেচ দিতে প্রতি শতকে ১৫ টাকা বা বিঘায় এক হাজার টাকা করে খরচ নেয়া হয়। সেটা বোরো মৌসুমে। আমনে হিসাবটা আরেকটু কম হওয়ার কথা। কিন্তু পানি কী পরিমাণ লাগবে এটার ওপর সবকিছু নির্ভর করবে।’

খরচের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন দুপচাঁচিয়ার উনহট গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে হাল দিয়ে জমি প্রস্তুত করা থেকে চারা রোপণ পর্যন্ত প্রতি বিঘায় অন্তত ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু বৃষ্টি কম হওয়ায় সেচের কারণে এই খরচ ১৫ হাজার বা তারও বেশি হতে পারে। অথচ আমন কৃষকদের জন্য নিশ্চিত ফসল। এবার বৃষ্টি যেন আরও কমে গেছে। এ অবস্থায় আমন আবাদে বাড়তি খরচের বোঝা চাপছে আমাদের ওপর।’

বৃষ্টিহীনতায় আমন চাষে পানির সংকটে রয়েছেন আদমদীঘির সান্তাহার ইউনিয়নের কৃষক আমিনুল ইসলাম সোহাগও। ৪০ বিঘা জমিতে তিনি আমন চাষ করবেন। সোহাগ বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষকরা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমেও সেচ দিতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সরকারের উচিত কৃষি বাঁচাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা। বৃষ্টির আশায় বসে থেকে আর লাভ নেই।’

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ৫ বছরে বগুড়ায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে বৃষ্টির পরিমাণ। দপ্তরটির বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র রেইন গজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বগুড়ায় ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ২০২০ সালে তা ছিল ৪৮৫ মিলিমিটার। তবে পরের বছর ২০২১ সালে বৃষ্টির পরিমাণ নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে, ২৭৭ মিলিমিটার। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২১১ মিলিমিটার। আর এ বছর চলতি জুলাইয়ে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৫২ মিলিমিটার।

জুলাই মাসের স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাত ধরা হয় ৪০৬ মিলিমিটার। এ হিসাবেও বৃষ্টিপাত প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। আবার বর্ষাকালের চার মাসের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩১ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানে ১ আগস্ট বগুড়ায় তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এসব বিষয় নিশ্চিত করেন বগুড়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিকভাবেই এবার উষ্ণতা বেশি। গাছপালা কেটে ফেলার পাশাপাশি নদী-নালা, খাল-বিল ভরাটসহ বায়ু দূষণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মূলত বৃষ্টি কম হয়। এর প্রভাবটা কৃষিতে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কৃষিবিদদের ভালো অবজারভেশন আছে। তবে কিছুদিনের মধ্যে বৃষ্টি বাড়ার সম্ভাবনা আছে।’

এবার আমন চাষে বাড়তি খরচের হিসাব জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও মিলেছে। জেলায় আমনের জন্য মোট ১০ হাজার ৯৬৯টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ডিজেলচালিত ৮ হাজার ৬২টি। প্রতি ঘণ্টায় একটি মেশিনে ডিজেল লাগে দেড় লিটার। আমনের জন্য গড়ে দিনে তিন ঘণ্টা করে মেশিন চালাতে হবে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন একটি মেশিনে ডিজেল লাগবে ৫ লিটার। আমনের মৌসুমে ৯০ দিন মেশিন চালালে ডিজেল প্রয়োজন হবে ৩৬ লাখ ৪১ হাজার ৪০০ লিটার। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১০৯ টাকা হলে শুধু এই খাতেই বগুড়ায় খরচ হবে কমপক্ষে ৩৯ কোটি ৬৯ লাখ ১২ হাজার ৬০০ টাকা।

বগুড়া কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে আমন আবাদে জমির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫০ হেক্টর। এর বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪৭৫ হেক্টর। এতে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮৫ টন চাল।

বগুড়ায় এবার আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৩৪ টন চাল। অথচ ১ আগস্ট পর্যন্ত অর্জন হয়েছে মাত্র ৬৫ হাজার ৪৬৪ হেক্টর।

বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সরকার শফি উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বগুড়া অঞ্চলের চার জেলায় পৌনে চার লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদ হয়। বেশি বন্যা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণসহ আরও অনেক কিছুর কারণে আমন চাষ কমতে বা বাড়তে পারে।

‘তবে বৃষ্টি কম হলে রোগ-বালাই কম হবে। আমন চাষের জন্য জেলায় বগুড়া অঞ্চলে ৩০ হাজার সেচযন্ত্র মাঠে আছে। এখন আমন চাষে সেচের বিকল্প নেই।’

ছবি ও তথ্যসূত্রঃ নিউজবাংলা24